গুহা অভিযান : পায়ে পায়ে মৃত্যু তাড়া করে যেখানে

গুহা অভিযান :পায়ে পায়ে মৃত্যু তাড়া করে যেখানে ‘দুনিয়ায় ভদ্র লোকের দাম নেই’-এমন কথা প্রায়শই বলে থাকি আমরা। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে পানি ভর্তি গুহায় বিচরণ বা অভিযানের ক্ষেত্রে বলা হয়, আনাড়ি আর ভীত ডুবুরির কোনো দাম নেই। তবে প্রথম কথাটি যেমন অনেকাংশে সত্য নয়, তেমনি গুহা অভিযানে আনাড়ি আর ভীতু হলেই যে বিপদ হবে, তাও সবসময় সত্য হয় না। কারণ অনেক দক্ষ ডুবুরিও মারা গেছেন এই গুহা ভ্রমন বা গুহা অভিযানে গিয়ে।

বিশ্বে সম্প্রতি গুহা শব্দটি ব্যাপক আলোচিত হয়েছে। থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চরীয় চিয়াং রাই প্রদেশের থাম লুয়াং গুহায় ১২ কিশোর এবং তাদের ফুটবল কোচ আকস্মিক বর্ষণজনিত কারণে আটকে যাওয়া এবং তাদের উদ্ধার অভিযান ছিল বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত ঘটনা। গত ২৩ জুন তারা নিখোঁজ হয়। ৯ দিন অনাহারে থাকার পর খোঁজ মেলে যে তারা জীবিত। তাদের উদ্ধারে চলা অভিযান ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। থাইল্যান্ডের নেভি সিলও বলেছে, এটি কি বিজ্ঞানের ফল না কি কোন অলৌকিক আশীর্বাদ সেটাই ভাবার বিষয়। ১৭ দিন পর ১৩ জনের সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

গুহার কথা

উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, বিশ্বে দেড় হাজারের বেশি গুহা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেই আছে ২৭৭টি। এশিয়ায় আছে চার শতাধিক গুহা যার মধ্যে চীনে ৩৮, ভারতে ৩২, আফগানিস্তানে ৩, ইরানে ২৬, নেপালে ৬, পাকিস্তানে ৪ ও শ্রীলংকায় ১৪টি। গুহাকে বিজ্ঞানীরা আট ভাগে ভাগ করেছেন। এদের ইংরেজি নাম এই রকম: সলিউশন কেভ, প্রাইমারি, লিটোরাল কেভ, ইরোশনাল কেভ, গ্লাসিয়ার কেভ, ফ্র্যাকচার কেভ, টেলাস ও অ্যানসিয়ালাইন কেভ। পৃথিবীর দীর্ঘতম গুহা যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি অঙ্গরাজ্যের মামুথ কেভ, পানির নীচের বড় গুহা মেক্সিকোর সিস্টেমা স্যাক অ্যাকটুন এবং গভীরতম জর্জিয়ার ক্রুবেরা। আর হ্যাংসন ডুং যাকে সবচেয়ে বড় গুহা নেটওয়ার্ক বলা হয়। ভিয়েতনামে অবস্থিত এর বড় কক্ষটি ২শ’ মিটার উঁচু, ১৫০ মিটার চওড়া। প্রায় ১৫০টি গুহার সমন্বয়ে গঠিত। মজার ব্যাপার, গবেষক দল গুহাটির আয়তন জানলেও এর শেষ খুঁজে বের করতে পারেননি। গুহার মধ্যে একদল গবেষক ২০০৯ সালে প্রবেশ করেন যেখানে বিষধর সাপ, বড় মাকড়সা, অদ্ভুত সব প্রাণী ও অজানা-অচেনা বৃক্ষরাজির দেখা পান। আছে একাধিক জঙ্গল ও ছোট ছোট পানির ফোয়ারা। থাইল্যান্ডের গুহায়ও পানির ফোয়ারা আছে। এই পানি কিশোরদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করেছে।

গুহা অভিযান, পায়ে পায়ে মৃত্যু তাড়া করে যেখানে

ধরা হয়, গুহায় প্রবেশের মাধ্যমে ডুবুুরি তার নিজের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে যান। যেমনটি ঘটেছিল থাই নেভি সিলের সাবেক ডুবুরি সামান কুনানের (৩৮) ক্ষেত্রে। ১২ শিশু ও তাদের কোচকে উদ্ধারের অভিযানে অংশ নিয়ে অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন কুনান। গত ৫ জুলাই এই দুর্ঘটনা ঘটে। ২০১৩ সালে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব অ্যাকুয়াটিক অ্যান্ড এডুকেশনে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বছরে ১০ গুহাচারী মারা যান। সংখ্যায় হয়তো কম মনে হতে পারে। তবে গুহায় যাওয়া ডুবুরির সংখ্যা খুবই কম। আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৩ সাল পর্যন্ত অন্তত ৪০০ ডুবুরি মৃত্যুবরণ করেছেন গুহায় অভিযানে। তাদের ৯৫ ভাগই অদক্ষ। ২০১৩ সালে ফ্লোরিডার গিনি স্প্রিং গুহায় ডুবুরি কার্লোস ফনসেকার এবং ২০১৭ সালে রেড সি’র ‘ব্লু হোল’ গুহায় স্টিফেন কেনানের মৃত্যু ছিল আলোচিত বিষয়। ব্লু হোলকে বলা হয় ডুবুরিদের সমাধি। সেখানে মৃতের নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায়নি। মিসরের তারেক ওমর নামের এক ডুবুরি অন্তত ২০ জনের মরদেহ তুলেছেন।

মহাকাশের প্রশিক্ষণ গুহায়!

গুহায় যাওয়ার জন্য মহাকাশে প্রশিক্ষণ নেওয়া হয় না। কিন্তু মহাকাশের পরিস্থিতি সামাল দিতে গুহায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কাজটি শুরু করেছিল ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা (ইসা)। কয়েকজন নভোচারী মিলে এমন এক পরিবেশে কাজ করতে হবে যা মহাশূন্যের মতোই বিপজ্জনক। সেই ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা গুহা। ছয় নভোচারীর আন্তর্জাতিক দল অংশ নেন। তাদের মূলমন্ত্র ছিল-‘ধীরই গতি’ ‘আগে যাচাই করো’, এরপর বিশ্বাস করো’ ‘তুমি কোথায়, তোমার সঙ্গী কোথায় তা মাথায় রেখে চলো। গুহার ভেতর নভোচারী বলে তাদের নাম দেওয়া হয় গুহাচারী (কেভনাট)।

বের করার উপায়

মার্কিন রেসকিউ কমিশনের সমন্বয়ক আনমার মির্জা জানান, প্রথমত ডুবুরি। এটা সবচেয়ে দ্রুতগতিতে সম্ভব, তবে খুবই বিপজ্জনক। পানি ভর্তি গুহায় আটকে পড়া কেউ যদি সাঁতার না জানে তাহলে সমস্যাটা বেশি হয়। যেটা থাইল্যান্ডে হয়েছে। গুহার পথও বেশ সরু। তাদের সহায়তা করতে সার্বক্ষণিকভাবে পাম্প করে বন্যার পানি সরাতে হয়েছে। কেভ রেসকিউ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংগঠন আইইউসিআরআরও’র সমন্বয়ক এড সোরেনসনের মতে, এটা খুবই বিপজ্জনক পন্থা। শেষ উপায় ছাড়া বিবেচনায় আসে না। দ্বিতীয়ত ড্রিলিং। এর সমস্যা অনেক। বিশেষ করে যদি আটকেপড়া মানুষগুলোর অবস্থান জানা না যায়। মির্জা বলেন, শুনতে সহজ শোনালেও কাজটা খুবই কঠিন-খড়ের গাদায় সুঁচ খোঁজার মতো।

আটকে পড়লে কী করতে হবে?

আনমার মীর্জার মতে, প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে গুহার মধ্যে পানি বাড়লে কতটা উচ্চতা পর্যন্ত তলিয়ে যেতে পারে সেই ধারণা করে নিরাপদ উঁচু জায়গা খোঁজা। খাবারের অপচয় না করা। কাপড় শুকনো রেখে উষ্ণ থাকা, শরীরের তাপমাত্রা যাতে অস্বাভাবিকভাবে না কমে সেদিকে খেয়াল রাখা, পানি পান করা, তবে নোংরা নয়। বাতাস নিয়ে মানুষ যতো ভয় পায় তার সব যথার্থ নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। বেশিরভাগ গুহার ভেতরে প্রাকৃতিক উপায়ে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আছে। যেসব স্থানে মানুষ ঢুকতে পারেন না সেখানেও বাতাস থাকে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। মূল কথা, প্রস্তুতি ছাড়া নাকটিও গুহার মধ্যে ঢোকানো উচিত নয়।

মেডিটেশন কেন?

থাই নেভি সিলসও মনে করে কিশোরদের টিকে থাকার পেছনে কাজ করেছে মেডিটেশন। তাদের কোচ মেডিটেশন জানতো। কমান্ডার আপাকর্ন ইওকনকাওয়ে বলেছেন, মেডিটেশনের কারণে বাচ্চারা ধীর স্থির ও শান্ত থাকতে পেরেছে। ফলে সেখানে অক্সিজেনের ব্যবহার কম হয়েছে। বিশেষ করে পানির নিচে ডুবসাঁতারের সময় এই কৌশল অবলম্বন করা হয় যাতে অক্সিজেনের ব্যবহার কম হয়।